রাজপথে সকালে শিবির রাতে ছাত্রলীগ ও ঢাকায় ছাত্র কনভেনশন
হঠাৎ করেই ঘোষণা দিয়ে রাস্তায় বিশাল শোডাউন করেছে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির। বুধবার (১১ অক্টোবর) সকালে রাজধানীর মতিঝিলে মিছিল করে ইসলামি ছাত্রশিবিরের কয়েক হাজার নেতাকর্মী। তাদের এই মিছিলের প্রতিবাদে একই দিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রাতে মশাল মিছিল করে আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা।
দীর্ঘদিন ১০ বছর পর গত জুন মাসে রাজধানীতে প্রকাশ্যে সমাবেশ করে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। এই ১০ বছরে ইসলামী ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীদেরও মাঠের রাজনীতিতে দেখা যায়নি। গত রবিবার (৮ অক্টোবর) আওয়ামী সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন, নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিতকরণসহ ৭ দফা দাবিতে সংবাদ সম্মেলন করেছে বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির। তার ২ দিনপর বুধবার সকালে একই দাবিতে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকা মতিঝিলে মিছিল করে সংগঠনের কয়েক হাজার নেতাকর্মী।
হঠাৎ কেন এই শোডাউন?
গত ২৯ সেপ্টেম্বের ১৫ ছাত্র সংগঠন নিয়ে ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্য’ নামে নতুন জোটের ঘোষণা আসে। সেই জোটে ইসলামি ছাত্রশিবিরসহ কোন ইসলামিক ছাত্র সংগঠনেরই জায়গা হয়নি। তারপর থেকেই আলোচনায় আসে ইসলামিক ছাত্র জোট নিয়ে। এর মাঝেই সামজিক মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে একটি ছবি প্রচার হয়। যেখানে দেখা যায় ইসলামি শিবিরের নেতৃত্বে ইসলামিক ছাত্রসংগঠনগুলো বৈঠক করছে। তার পর থেকেই নতুন ইসলামিক ছাত্র জোটের গুঞ্জন উঠে। ধারণা করা হচ্ছে বুধবার শিবির যে শোডাউন দিয়েছে তা মূলত ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্যকে দেখানোর জন্যই। কারণ তার একদিন পর অর্থাৎ বৃহস্পতিবার ঢাকায় ছাত্র কনভেনশন করবে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের নেতৃত্বাধীন ১৫ টি সংগঠন। ছাত্রদল যে জোট গঠন করেছে তার অধিকাংশ বাম মতাদর্শ নামসর্বস্ব এবং জনশক্তিশূণ্য। অপরদিকে ছাত্র শিবির ১০ বছর ভিতরে ভিতরে শুধু ঢাকাতেই যে জনশক্তি তৈরি করেছে তা দৃশ্যমান হয়েছে বুধবারের সমাবেশে। তাই বৃহস্পতিবারের ছাত্র কনভেনশন বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে শিবিরের শোডাউনের কারণে। বৃহস্পতিবার প্রশ্নবিদ্ধ বামদের নিয়ে ছাত্রদলের জোট কতটা শক্তি দেখাবে তার উপর নির্ভর করছে আগামী দিনে সরকার বিরোধী ছাত্র জোট কারা নেতৃত্ব দিবে।
আওয়ামী সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে সুষ্ঠু নির্বাচন, নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিতকরণসহ ৭ দফা দাবিসমূহ হলো-
১. ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ সরকারের পদত্যাগ ও সাধারণ মানুষের ভোটাধিকার ফিরিয়ে দিতে নির্দলীয় নিরপেক্ষ কেয়ারটেকার সরকারের অধীনে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
২. আমিরে জামায়াত ডা. শফিকুর রহমান, বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া, ইসলামী ছাত্রশিবিরের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি রফিকুল ইসলাম খান, সেলিম উদ্দীন, মানবাধিকার কর্মী আদিলুর রহমানসহ সব আলেম ওলামা, ছাত্রনেতা ও বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীকে নিঃশর্ত মুক্তি দিতে হবে। সেই সাথে তাদের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
৩. ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কার্যালয় ও সারা দেশের অফিসগুলো খোলার সুযোগ করে দিতে হবে। সেই সাথে ছাত্রসংগঠন হিসেবে সব রাজনৈতিক ও ছাত্রবান্ধব কর্মসূচি নির্বিঘ্নে পালনের সুযোগ দিতে হবে।
৪. দেশের ক্যাম্পাসগুলোতে সব ছাত্র সংগঠনের সহঅবস্থান নিশ্চিত করা ও ছাত্রসংসদ নির্বাচন আয়োজনের মাধ্যমে ছাত্র রাজনীতির সুস্থ ধারা চালু রাখতে হবে। সেই সঙ্গে ক্যাম্পাসে অবস্থানরত সব শিক্ষার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার মধ্য দিয়ে ক্যাম্পাসগুলোকে নিরাপদ করতে হবে।
৫. প্রস্তাবিত ২০২০ শিক্ষানীতি বাতিল করে নৈতিকতাসমৃদ্ধ, কারিগরি ও বাস্তবমুখী শিক্ষানীতি প্রণয়ন করতে হবে, যেখানে সব পর্যায়ে ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক থাকবে। সেই সাথে মাদ্রাসা শিক্ষাব্যবস্থাকে সংস্কার ও উন্নত করে আরো যুগোপযোগী করতে হবে। ৬. সকল পর্যায়ে অর্থাৎ প্রাথমিক থেকে স্নাতক পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করতে হবে। সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর শিশুদের অবৈতনিক শিক্ষা দান নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে কাগজ-কলমসহ সব প্রকার শিক্ষা উপকরণের মূল্য হ্রাস করতে হবে।
৭. দেশের মোট বাজেটের ২৫ ভাগ শিক্ষা খাতে বরাদ্দ দিতে হবে এবং শিক্ষা বাজেটের এক-চতুর্থাংশ গবেষণায় ব্যয় নিশ্চিত করতে হবে। সেই সাথে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে সরকারি ভ্যাট হ্রাস করতে হবে।
ভোটাধিকার, সন্ত্রাস-দখলদারিত্বমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাস, সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় 'ফ্যাসিবাদ বিরোধী ছাত্র ঐক্য' এর ঘোষিত ৯ দফা দাবির গুলো হচ্ছে:
১) বর্তমান ফ্যাসিবাদী সরকারের পদত্যাগ, নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন ও রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সংস্কারে আন্দোলনরত দলগুলোর ৩১ দফা বাস্তবায়ন কর।
২) শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের সমস্তক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক চর্চাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। শিক্ষাক্ষেত্রে জিডিপির অন্তত ৫ ভাগ বরাদ্দ করে সবার জন্য মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণায় সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ। দক্ষ জনশক্তি গড়ে তোলার লক্ষে কারিগরি শিক্ষার বিকাশ। বুনিয়াদি শিক্ষাকে সার্বজনীন, অবৈতনিক ও মানসম্মত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা।
৩) সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দিদের নিঃশর্তমুক্তি এবং সাইবার সিকিউরিটি আইনসহ নিবর্তনমূলক সব আইন বাতিল করতে হবে।
৪) শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্যাতনবিরোধী আইন করে শিক্ষাঙ্গনগুলোকে সন্ত্রাস ও দখলদারিত্ব মুক্ত করা, সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন, প্রথম বর্ষ থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে ছাত্রদের সিট পাওয়ার বৈধ অধিকারের স্বীকৃতি এবং বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গ্রহণ। সর্বোপরি দলমত নির্বিশেষে সব সংগঠনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে।
৫) শিক্ষার মান বাড়ানোর লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, শিক্ষকদের বেতন কাঠামোর পুনর্বিন্যাসসহ বহুমুখী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভ্যাট (মূল্য সংযোজনী কর) আরোপ করা চলবেনা। বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বেতন-ফি কমানো এবং অভিন্ন নীতিমালা ও বেতন কাঠামো নির্ধারণ কর।
৬) সারা বিশ্বের সমস্ত ধ্রুপদী সাহিত্য ও পাঠ্যপুস্তকে মাতৃভাষায় রূপান্তরের জন্য একটি জাতীয় অনুবাদ সংস্থা স্থাপন করে দ্রুততার সঙ্গে এ কাজ সম্পন্ন করতে হবে।
৭) বাংলাদেশের জনগণের নির্ধারক ভূমিকাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং ইতিহাসে সব ব্যক্তির যার যা অবদান আছে তার স্বীকৃতি দিয়ে বাংলাদেশের জনগণের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে প্রতিষ্ঠা এবং জনগণের সামনে প্রকৃত ইতিহাস তুলেধরার জন্য পাঠ্যপুস্তক সংস্কার করতে হবে।
৮) শিক্ষার্থীদের মেধা ও যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষা গ্রহণের সমস্তব্যবস্থা এবং শিক্ষা শেষে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শিক্ষার্থীদের সহজ শর্তে শিক্ষা ঋণ দিতে হবে। সব শিক্ষার্থীকে স্বাস্থ্যবীমার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করার জন্য সহজ শর্তে ঋণ দিতে হবে।
৯) সব জাতিসত্ত্বার সাংবিধানিক স্বীকৃতি ও সাংবিধানিক নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।
প্রতিনিধি সভায় ছাত্রদলের সভাপতি রাশেদ ইকবাল খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতারা বক্তব্য রাখেন।