করোনা আঘাত করতে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে
- - নিউজ রুম -
- ডেস্ক রিপোর্ট --
- 16 April, 2020
বর্তমানে আমাদের মাথায় যেসব ব্যাপার ঘোরাফেরা করছে সেগুলো হল, করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু কিংবা ক্ষুধা এবং দূর্ভিক্ষ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা তার এক প্রতিবেদনে বলছে, বাংলাদেশে পাঁচ লাখ থেকে বিশ লাখ মানুষ মারা যেতে পারে কিন্তু শুধুমাত্র মৃতের সংখ্যা দিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা পরিমাপ করাটা বোকামি। বাংলাদেশ এমনিতেই অধিক জনসংখ্যার ঘনত্ব প্রবণ দেশ। সম্প্রতি মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করলেও জিডিপির হিসেবের বাইরেও কিছু তথ্য-উপাত্ত আছে যা আসলে ভিন্ন কথা বলে। আমি আগেও দেশের বস্তি পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি কিন্তু অনেকেই ভাবছেন দেশে বস্তিতে আর কতোজন মানুষ বসবাস করেন। বাংলাদেশে সর্বশেষ সরকারি বস্তি শুমারী হয় ২০১৪ সালে, পরিসংখ্যান ব্যুরোর এই শুমারী থেকে জানা যায় ২০১৪ সালে দেশে মোট বস্তি ছিল ১৩৯৯৪ টি যার মোট জনসংখ্যা ২২ লাখ ৩২ হাজার জন। বিবিএস এর এই তথ্য নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক রয়েছে। ২০১৪ সালে করা বস্তি শুমারী থেকে জানা যায় ১৯৯৭ সালের বস্তি শুমারীর তুলনায় ১৭ বছরে বস্তিতে বসবাসকারী মানুষের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছিল প্রায় চারগুণ। ২০২০ সালে এসে আমরা বলতেই পারি এই জনসংখ্যা আরোও বেড়েছে।
২০১৪ সালের বিবিএস এর করা জরিপ থেকে জানা যায় শুধুমাত্র ঢাকাতেই বস্তি আছে,৩৩৯৪ টি। এই বস্তিগুলোতে মোট ঘর আছে ১ লাখ ৭৫ হাজারটি এবং মোট জনসংখ্যার পরিমান ৬ লাখ। ২০১৩ সালে "মাল্টিপল ইন্ডিকেটর ক্লাস্টার সার্ভে (এমআইসিএস)" এর তথ্য অনু্যায়ী বস্তিতে বসবাসকারী পরিবার গুলোর প্রায় পচাত্তর শতাংশ একই কক্ষে বসবাস করে। অন্যদিকে ইউনিসেফের জরিপ অনুযায়ি বস্তিতে বসবাসকারী পরিবারগুলোর সদস্য সংখ্যা গড়ে ৪.৩ জন। ২০১৯ সালে এসে ইউনিসেফ বলছে, শুধুমাত্র ঢাকাতেই বস্তির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ হাজারে এবং এর মোট জনসংখ্যা প্রায় চল্লিশ লাখ।
কেন আমরা এই পরিসংখ্যান গুলো দেখছি? কারণটা জানতে পারবেন 'কালের কন্ঠে' প্রকাশিত ২১/১১/২০১৮ তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে যেখানে দাবি করা হয়েছে,বস্তির প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ নূন্যতম স্বাস্থ্যসেবা এবং পর্যাপ্ত স্যানিটেশন সুবিধা থেকে বঞ্চিত।
আমরা বলতেই পারি করোনার প্রাদুর্ভাবের সময়ও এই বস্তিগুলো পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবার আওতার বাইরেই থেকে যাবে। আমার নিজের কাজ করার সুবাদে আমি খুবই স্বল্প আকারে একটি জরিপ চালাতে পেরেছিলাম প্রায় ২০ টি পরিবারের উপর। ১০/৪/২০২০ তারিখেই এই ২০টি পরিবারের মধ্যে ১৬ টি পরিবারের ঘরে খাবার ছিলনা এবং তারা সরকারি এবং বেসরকারি কোনও ত্রাণও পাননি। এই ২০ টি পরিবারের প্রত্যেকটিই নিম্ন আয়ের পরিবার এবং করোনায় সাধারণ ছুটি এবং একধরনের লকডাউনের কারণে পরিবারের প্রধানসহ অন্যান্য কর্মজীবি মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছিলেন। যদি আমরা ইউনিসেফের দেওয়া তথ্যের দিকে তাকাই তবে দেখা যাবে শুধুমাত্র ঢাকার বস্তিতে বসবাসকারী প্রায় ৪০ লাখ মানুষ বেঁচে আছেন চরম অনিশ্চয়তার ভেতর। বস্তিগুলোর বসবাসের পরিবেশের কারণেই এখানে করোনার প্রাদুর্ভাব হতে পারে মারাত্মক। খুব সঙ্গত কারণেই বস্তিগুলোতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখাটা প্রায় অসম্ভব। একই রান্নাঘর, গণ শৌচালয় ও নলকুপের কারণে এখানে মানুষের মধ্যে শুধুমাত্র ঘরে নিজেকে আটকে রাখার চিন্তাও করা যায় না। এসব কিছুর পরেও বাংলাদেশে এখন বৈশাখ মাস অর্থাৎ গ্রীষ্মকাল। প্রচন্ড দাবদাহে বস্তির টিনের ঘরগুলো নরকের চেয়েও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। এই ঘরগুলোতে বসবাসকারী মানুষগুলো বাধ্য হয়েই গাদাগাদি করে থাকে। করোনার দিনগুলোতে বস্তিগুলোয় করোনা আঘাত হানার আগেই আঘাত হেনেছে ক্ষুধা। বস্তির মানুষের মধ্যে করোনা নিয়েও কোন সচেতনতা সৃষ্টির উদ্যোগ চোখে পড়েনি সরকারি ভাবে। বেসরকারি কিছু জায়গা থেকে উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা পর্যাপ্ত নয়। পরিক্ষা-নিরিক্ষা করতে আগ্রহী নয় বস্তির বেশিরভাগ মানুষ ফলে পরিস্থিতি হতে পারে আরোও ভয়াবহ। কমিউনিটি ট্রান্সমিশন এর মাধ্যমে আক্রান্ত হবে বেশিরভাগ মানুষ পর্যাপ্ত টেস্ট এবং চিকিৎসা সুবিধা না পাওয়ার কারণে মৃত্যুর হারও হবে বেশি। ক্ষুধা এবং খাদ্যাভাব দেখা দেবে মারাত্মক আকারে। সেচ্ছাসেবী কিংবা দাতব্য প্রতিষ্ঠান গুলোর জন্যেও বস্তিতে কাজ করা হয়ে উঠেছে ঝুঁকিপূর্ণ অথচ দায়িত্বশীল মহলের কাছ থেকে এখনো কোন কার্যকর পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায়নি।
কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতেও লাগতে যাচ্ছে ধাক্কা
গত তিন-চার বছর থেকে কৃষক তার ধানের পর্যাপ্ত দাম পাচ্ছেন না, গত বছর এর ভয়াবহ চিত্র আমরা দেখেছি। কৃষি শ্রমিকের সংকটও প্রকট। এবারও আমনের মৌসুমে ধানবীজের দাম কমে যাওয়ায় কৃষক বিপদে পড়েছে। ২০১৮ সালের কৃষিমন্ত্রনালয়ের তথ্য অনুযায়ী দেশে মোট উৎপাদিত চালের পরিমান প্রায় ৩৩৮.০৪ লক্ষ মেট্রিক টন যার একটা বিরাট অংশ তথা ১৩৬.৫৬ লক্ষ মেট্রিক টন আসে আমন ধান থেকে। বাকিটা উৎপাদিত হয় ইরি এবং বোরো মৌসুমে। এবার করোনার আঘাত আসতে যাচ্ছে বোরো ধান কাটা এবং আমনের উৎপাদনের উপর। আগামী কাল থেকে হাওর অঞ্চলে এবংদুই সপ্তাহের মধ্যে উত্তরাঞ্চলের ধান কাটার মৌসুম শুরু হয়ে যাবে। সঠিক সময়ে ধান কেটে ঘরে তুলতে না পারলে অর্থনৈতিক হুমকির মধ্যে পড়বে দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০.৬ শতাংশ মানুষ যারা মূলত কৃষি নির্ভর জীবন যাপন করে।
বনিকবার্তা তার প্রতিবেদনে বলছে, প্রায় ৬৬ হাজার অভিবাসি শ্রমিক লাগবে এবার হাওড় অঞ্চলে,মোট শ্রমিকের ১৮ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে এবার। পাহাড়ি ঢল এবং বন্যার সম্ভাবনা থাকায় ধান কেটে ঘরে তুলতে হবে দ্রুত। এছাড়াও আমনের উৎপাদনে করোনার ধাক্কা লাগলে দেশ একটা দীর্ঘ মেয়াদি খাদ্য সংকটে পড়তে পারে। গত তিন-চার বছরে এমনিতেই কৃষকের মাথাপিছু ঋণের পরিমান বেড়েছে তার উপর এ ধরনের ঘটনা মারাত্মক হতে পারে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নেওয়া হলে পরিস্থিতি আরোও জটিল হয়ে উঠবে। সরকারের পক্ষথেকে ৫% সুদে কৃষককে ঋণ দেওয়ার ঘোষনা আসলেও খুব আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। এই ঋণের ঠিক কতটুকু প্রকৃত কৃষকের কাছে পৌছুবে তা বলা মুশকিল। এ সময়ে প্রকৃত কৃষকদের বিনা সুদে ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ কিছুটা কাজ করত। কৃষি অর্থনীতি ঠিক রাখতে যে দীর্ঘ মেয়াদি পদক্ষেপ নেওয়া দরকার তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল কৃষক যাতে তার উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্য প্রায় সেটা নিশ্চিত করা। এর পাশাপাশি নিরবিচ্ছিন্ন উৎপাদন যাতে নিশ্চিত হয় সেদিকে নজর দেওয়া। নয়তো ৫% সুদে দেওয়া ঋণ কৃষকের মাথায় ঋণের বোঝা বাড়া ছাড়া আর কোন লাভ হবে না।
ধাক্কা লাগবে শ্রমশক্তি রপ্তানিতেও
২০২০ সালের প্রথম ১৫ দিনে প্রবাসী শ্রমিকরা দেশে পাঠিয়েছেন ৯০ কোটি ৭০ লাখ ডলারের রেকর্ড পরিমান রেমিট্যান্স। কিন্তু করোনার পৃথিবীব্যাপি আগ্রাসনে বেকার হয়ে পড়েছেন বেশিরভাগ প্রবাসী শ্রমিক। বিদেশে কর্মরত আছেন দেশের প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ বাংলাদেশি শ্রমিক। যার একটা বিরাট অংশ মধ্যপ্রাচ্যে এবং পশ্চিমা দেশগুলায়। ফলে করোনার কারণে স্তিমিত হয়ে গেছে রেমিট্যান্স প্রবাহ।
২০১৮-২০১৯ অর্থবছরে দেশের অর্থনীতিতে রেমিট্যান্স এর অবদান ৫.৪৭ শতাংশ। এই পরিমান আরো কমলে দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব হবে ভয়াবহ। করোনা পরবর্তী পৃথিবী হয়তো নতুন কিছু সমস্যার সম্মুখীন হবে, বাংলাদেশ করোনা নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে শ্রমশক্তি রপ্তানির ক্ষেত্রে একটা বড়সড় বাধা আসতে পারে। এই ব্যাপারে এখনই ভাবতে হবে নয়তো পরিস্থিতির মোকাবেলা করা সম্ভব নয়।
২০/০১/২০১৯ তারিখে প্রথম আলোর প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশে ২ কোটি ৪১ লাখ হতদরিদ্র মানুষ রয়েছেন যাদের দৈনিক আয় ৬১ টাকা ৬০ পয়সার নিচে। এই মানুষগুলোর জীবন করোনা কালে সর্বোচ্চ ঝুঁকিতে আছে। খাদ্য ও চিকিৎসার কোন নিশ্চয়তা নেই। নেই সরকারি কিংবা বেসরকারি দীর্ঘ মেয়াদি কোন উদ্যোগ। কিন্তু দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে এদের অবদান গুরুত্বপূর্ণ। পুরো ব্যবস্থাটাই দাঁড়িয়ে আছে এই হতদরিদ্র মানুষদের কাঁধে। ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় যে সংকট এবং অব্যস্থাপনা দেখা দিয়েছে তার আশু সমাধান প্রয়োজন নাহলে এপ্রিলের শেষ থেকে অবস্থা আরোও জটিল হয়ে যাবে। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এ সময়টাতে করোনার প্রকোপ বাংলাদেশে সর্বোচ্চ হতে পারে। দেশের গার্মেন্টস শিল্পে নিয়োজিত আছেন প্রায় ৪৪ লাখ মানুষ। গত ২৬ শে মার্চ থেকে শুরু হওয়া সাধারণ ছুটির কারণে এই ৪৪ লাখ মানুষ কার্যত কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। গার্মেন্টস গুলোতে শুরু হয়েছে শ্রমিক ছাঁটাই এবং লে অফ। সাড়ে পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্যাকেজ ঘোষণার পরেও সারাদেশ থেকে শ্রমিকদের হাঁটিয়ে তাদের কর্মস্থলে আনার সময়েও সরকারের ভুমিকা ছিল নিরব অথচ এই মানুষগুলোই জিডিপিতে অবদান রাখেন সবচেয়ে বেশি।
করোনার কারণে পৃথিবীতে যে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে তার ভেতর টিকে থাকতে গেলে এই সময়ে এরকম হাজারটা সমস্যাকে সাহস ও স্বদিচ্ছা নিয়ে মোকাবেলা করতে হবে সরকারের। সিন্ডিকেট ব্যবসার মাধ্যমে এবং সামনে রোজায় মানুষকে জিম্মি করে কেউ যাতে ফায়দা লুটতে না পারে তার জন্য পর্যাপ্ত প্রস্তুতি প্রয়োজন নয়তো করোনা পরবর্তী পরিস্থিতি হবে চরম মাত্রায় ভয়াবহ। দেশ আবার একটা দীর্ঘকালিন সময়ের জন্য পিছিয়ে পড়বে। এই সময়ে দূর্নীতি রোধ করে সকল কার্যক্রম পরিচালনাই সরকারের জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
লেখক: জাফর মুহাম্মদ, চিন্তক, সিভিএন